লিখেছেন : মুফতি পিয়ার মাহমুদ
বাংলা ভাষা। সর্বস্তরের বাঙালির প্রাণের ভাষা। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গবেষক ও প্রবাদ পুরুষ আল্লামা সাইয়ীদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী- ‘বাংলা ভাষার সাধারণ চর্চা এখন আর যথেষ্ট নয়। এ কাজ সবাই করবেন। এখন কিছু মানুষকে বাংলা ভাষার কর্তৃত্ব হাতে নেয়ার জন্য প্রাণপণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। এটা যেমন আলিমদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরি, তেমনি বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান ও খোদ বাংলা ভাষার জন্যও অপরিহার্য। বাংলা ভাষার শোধন, সংস্কার ও সমৃদ্ধির জন্য এ কাজ অপরিহার্য। কেননা দীর্ঘ দিন যাবত বাংলা ভাষার কতৃত্ব ইসলাম বিরোধী শিবীরের হাতে। যাদের চিন্তা ও চেতনা এবং জীবন ও চরিত্র কলুষমুক্ত নয়; বরং তারা বিভিন্ন ধরণের আকীদা ও চিন্তাগত ভ্রান্তিতে আক্রান্ত। তাদের লালনে এ ভাষাতেও প্রবেশ করেছে কলুষ ও চিন্তার বিষবাষ্প। এ জন্য বাংলা ভাষায় রুহ ও রুহানিয়াত ও প্রাণ ও প্রাণময়তা সৃষ্টি ও সঠিক পরিচর্যার জন্য এমন কিছু মানুষকে প্রাণপণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে, যারা সমুন্নত চিন্তা-চেতনা এবং পবিত্র রুচি ও আদর্শের অধিকারী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় কোনো পুণ্য নেই, যত পুণ্য সব আরবী আর উরদুতে, এ ধারণা বর্জন করুন। এ ধারণা নিছক মূর্খতা। তিনি আরো বলেছেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ইসলাম বিরোধীদের রহম-করমের উপর ছেড়ে দিবেন না। ‘ওরা লিখবে আর আপনারা পড়বেন’ এ অবস্থা কিছুতেই বরদাশত করা উচিৎ নয়।’ (১৯৮৪ সালের ১৪ই মার্চ জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ প্রাঙ্গণে বিশিষ্ট আলেম-উলামা, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণ)।
তবে আক্ষেপের ব্যাপার হলো, দীর্ঘকাল খোদার সৃষ্টি আমাদের এ ভাষাটি মুসলামনদের অবহেলার শিকার ছিল। তখন তার দখল ছিল হিন্দু দাদা-বাবুদের হাতে। ফলে সংস্কৃতের দানা-পানি খাইয়ে তার যেমন চেহারা বদলে দিয়েছে দেব-দেবীর পূঁজারী দাদা-বাবুরা, তেমনি এর চর্চা শিকার হয়েছে ভয়াবহ সংকীর্ণতা ও নীচুতার। গল্প, কবিতা, উপন্যাসসহ সাহিত্যের কোনো দর্পণেই বিম্বিত হতে পারে নি ইসলাম ও মুসলমানের যাপিত জীবন।
তবে আশার কথা হলো, ১৯৪৭ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে মুসলমান ও আলেম-উলামাগণ এ দিকে নজর দিতে শুরু করেন। ফলে বাংলা ভাষা যখন উদার আলেম-উলামা ও মুসলমানদের পরশ পেয়ে মাত্রা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে তখনই পাকিস্তানের নির্বোধ শাসকদের মাথায় চাপে একের ভাষা অপরের উপর চাপিয়ে দেয়ার নাদান ভূত। তখনই গর্জে উঠে বাংলার দামাল ছেলেরা। ঢাকার রাজপথ লাল হয় যুবকদের তপ্ত রক্তে। বাতাসে ঢেউ উঠে প্রতিবাদের। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের বহিৃশিখা। এই আন্দোলনে সচেতন অন্য সকলের মতো আলেম সমাজও অংশগ্রহণ করেন দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। এ ক্ষেত্রে আমরা সবিশেষ উল্লেখ করতে পারি মাওলানা আতহার আলী রহ. এর নাম। ঐতিহাসিক দলীল মতে ১৯৫২ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ কিশোরগঞ্জের হজরত নগরে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্মেলেন। এই সম্মেলনে সর্ব মহলের আলেম-উলামাগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৮ মার্চ ছিল কাউন্সিল। সভাপতি ছিলেন মাওলানা আতহার আলী রহ.। এই কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘চতুর্থ প্রস্তাব: খ.পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের এই সম্মেলন পাকিস্তান গণপরিষদের নিকট দৃঢ়তার সহিত দাবি জানাইতেছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা রুপে গ্রহণ করা হোক।’
তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান নেযামে ইসলাম পার্টির জন্য প্রণীত মূলনীতিতেও তিনি এই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে উত্থাপন করেন- ‘উর্দুর সাথে বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’ এক কথায় উভয় পাকিস্তান থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবকারী তিনিই প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। (হায়াতে আতহার: ১৩৮-১৩৯) এখানেই কি শেষ? সেই সময় তিনি কওমী মাদরাসার তালিবুল ইলমদের বাংলা ভাষায় দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন ‘মুতামুরুল মাদারিসিল কাওমিয়্যা।’ তখন তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দীনী বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ এর প্রধান। সেখানে তিনি দক্ষ অভিজ্ঞ বাংলার শিক্ষক রেখে ছাত্রদের ভালভাবে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁর এই চৌকস উদ্যমতা দেখে অনেকে শংকিত হোন এই ভেবে যে, মাওলানা আবার জামিয়াকে কলেজ বানিয়ে ফেলেন কি না? তাঁর সযত্ম তত্ত্বাবধানে তখন নিয়মিত বেশ কিছু পত্রিকাও প্রকাশিত হত। দৈনিক নবজাত, সাপ্তাহিক নেযামে ইসলাম ও মাসিক মুনাদী তার মধ্যে অন্যতম। এখানে আমরা আরো স্মরণ করতে পারি ইসলামের রসে সিক্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বর্ণসন্তান মুজাহিদে আজম মাওলানা শামছুল হক ফরীদপুরী, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক ও মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ. কে।
হযরত ফরীদপুরী এর রচনা ভান্ডার যেমন বিশাল তেমনি বিষয় বৈচিত্র্যে বর্ণাঢ্য। হযরত থানবী রহ. এর বেহেশতী যেওর এর বাংলা তরজমা থেকে বিশাল তাফসীরে হক্কানী পর্যন্ত তাঁর এই দীঘল কলম সংগ্রাম তাকে এনে দিয়েছিল বাংলার থানবী স্বীকৃতি। তাঁরই মজবুত ও দক্ষ হাত ধরে উঠে আসেন তাঁর সূর্যশিষ্য শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। বাংলায় তাঁর অনূদিত ও সম্পাদিত দশ খন্ডে প্রকাশিত বুখারী শরীফের বর্ণাঢ্য ব্যাখ্যা গ্রন্থ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন্য এক অপার গৌরবের প্রতীক। লাখো ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষিত মানুষ তাঁর সে অপার কীর্তিতে সিক্ত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। আমাদের এই দুই মহান মনীষীর দক্ষ হাতে প্রতিষ্ঠিত মাসিক নেয়ামত ও মাসিক রহমানী পয়গাম এখনো বিলিয়ে যাচ্ছে সাহিত্য রসে সিক্ত করে ঐশি চেতনায় প্রজ্জোল ইসলাম ও ঈমানের আলো। ইসলামের রসে তৃপ্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নিকট অতীত কাফেলার আরেক প্রবাদ প্ররুষ হচ্ছেন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ.। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত মাসিক মদীনাও প্রবাদতুল্য। বলতে গেলে সাধারণ শিক্ষিত মানুষ তো ইসলাম সর্ম্পকে জানার জন্য মাসিক মদীনার দিকেই তাকিয়ে থাকেন এখনো। এই এক মাসিক মদীনাই তাকে দেশ-বিদেশে খ্যাতির শীর্ষে পৌছে দেয়। আর তাফসীরে মারিফুল কুরআনের অনুবাদ তো এনে দিয়েছিল আকাশচুম্বী খ্যাতি। এ ছাড়াও জনপ্রিয় সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানও তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠিত। তাঁর অনূদিত, সম্পাদিত ও স্বলিখিত বই এর বিশাল ভান্ডার তো কালের সাক্ষী। যার সংখ্যা ১০৫টি।
আসল কথা হলো, এ উপমাহাদেশে বিভিন্ন কারণে উরদু, ফারসীর বিশাল প্রভাবের ফলে এক সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার দিকে আলেম সমাজ ও সাধারণ দীনদার শ্রেণী দৃষ্টি দিতে পারেন নি। ফলে পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত এ দেশে আলেমগণের মধ্যে কারা বাংলা ভাষায় লেখা-লেখি করেছেন, পত্রিকা প্রকাশ করেছেন, বাংলা ভাষায় বলা ও পাঠদানকে উৎসাহিত করেছেন তার একটা তালিকা খুব সহজেই করা সম্ভব। কিন্তু আশি থেকে নব্বই এর দশকে এসে এই তালিকাটা আর হাতের মুঠোয় থাকে না। আর একুশ শতকে এসে থাকে না সাধ্যের সীমানায়। সব মিলে সে তালিকা এখন বিস্ময়কর। তাদের লিখিত ও সম্পাদিত মাসিক, সাপ্তাহিক, সাহিত্য চর্চার ম্যাগাজিন আর কোনো উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারকের সংখ্যার তালিকাও বিস্ময়কর। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে।
খালেস দীনী স্টাইলে খালেস দীনী বিষয়ে যেমন লেখা হচ্ছে, তেমনি লেখা হচ্ছে আধুনিক স্টাইলে ধর্মীয় বিষয় বা সাধারণ বিষয় নিয়ে। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস সবই ঝরছে কওমী ক্যাম্পাস থেকে। কওমী ক্যাম্পাসে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে এমন একটি শক্তিশালী কাফেলা। ফলে ইসলামের বিমল গায়ে কেউ মলের আঁচড় দিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যাবে তা আর এখন ভাবা যায় না। এই মিছিল প্রতিদিনই বড় হচ্ছে। হচ্ছে দিঘল। এই কাফেলার হালের স্বর্ণসন্তান হলেন- মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ, মাওলানা এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী, মাওলানা কবি রুহুল আমীন খান, মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী, মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী, মাওলানা লেয়াকত আলী, মুফতী আবুল হাসান আব্দুল্লাহ, মাওলানা আ.ফ.ম. খালিদ হোসাইন, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা যাইনুল আবিদীন, মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ, মাওলানা লাবীব আব্দুল্লাহ, মাওলানা গোলাম রব্বানী, মাওলানা জহির উদ্দীন বাবর প্রমুখ।
সত্যি কথা কি, আমাদের আত্মার স্পন্দন, মানব ও মানবতার অহঙ্কার হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীন প্রচারের যে মহান মিশন নিয়ে আলো আধারের দুনিয়ায় এসেছিলেন এবং স্বজাতির ভাষাকে যে মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে তুলে নিয়েছিলেন অব্যর্থ অস্ত্র রুপে, আমরা সে মিশন ও অস্ত্রকে ছাড়তে পারি না।
Leave a Reply