নুরুল হক শিপু ::
সিলেটে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে ওঠেছে দলবদ্ধ ‘কিশোর গ্যাং’। ‘কিশোর গ্যাং’-আড্ডায় যোগ দেন তরুণ বখাটে, ছিনতাইকারী, মাদকসেবী এবং তির জুয়াড়িরা। আর ‘বীরত্ব’ দেখাতে তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়ে সিলেট নগরীতে তারা এখন বেপরোয়া। কিন্তু মাঝে-মধ্যে ‘কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে অভিযানে নামছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’ এমন খবর শুনা গেলেও মূলত দৃশ্যমান কোনো অভিযান হয়নি এখনও।
সূত্র মতে, কেউ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে, কেউ চালাচ্ছে টমটম অটোরিকশা কারো বাবার আছে অঢেল অর্থ সম্পদ। টাকা হাতে থাকায় তারা দ্রুত গ্রুপ তৈরি করে দাপট দেখান। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান করে ছাত্রীদের উত্তক্ত করা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক সেবন, ছিনতাই, তির জুয়া, মারামারি এসব কাজ এখন ‘কিশোর গ্যাং’-এর মূল নেশা। বিভিন্ন সময় ‘কিশোর গ্যাং’-এর সদস্যরা আইনের আওয়াতায় আসলেও আড়ালেই থেকে যান তাদের নেতৃত্ব দানকারী রড়ভাইয়েরা।
সিলেট মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, সিলেট নগরীর ৬ থানা এলাকায় ২২০ জন তরুণের নাম ‘কিশোর গ্যাং’-এর সাথে জড়িৎ হিসেবে তালিকা করা হয়েছে। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে বড় ভাইয়েরা এদের শেল্টারদেন। ‘কিশোর গ্যাং’ এখন বড় ধরনের একটি সামাজিক সমস্যা। উদ্ভট নাম নিয়ে গড়ে ওঠা এসব দলের অনেক সদস্যই স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার হয়নি। বিশেষত সিলেটে কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডব এখন প্রকট হয়ে ওঠেছে। নগর পুলিশের তালিকা অনুযায়ী ১৫-২০ টি ‘কিশোর গ্যাং’ নগরীতেই রয়েছে, যাদের সদস্য অন্তত আড়াইশয়ের উপরে। যাদের মধ্যে ২২০ জনের তালিকা এখন মহানগর পুলিশের হাতে রয়েছে। তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যে বয়সে বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, মাঠে খেলার কথা, সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতিভা বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা—সেই বয়সের কিশোররা এখন ছুরি-চাকু, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাস্তানি করে, মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। রাস্তাঘাটে ছিনতাই করে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। বাধা দিলে রক্তারক্তি, খুুনাখুনি করে।’
তিনি বলেন, ‘সিলেট মহানগর পুলিশ যেহেতু ‘কিশোর গ্যাং’-এর তালিকা করেছে। পুলিশের উচিৎ ওই তালিকা থানায় থানায় টানিয়ে দেয়া একই সাথে অভিভাবকদের উচিত খবর নেয়া তাদের সন্তান কি পুলিশের করা তালিকায় রয়েছেন কি-না।’
ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এখনই সময় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, তাদের সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তাদের খবর না রাখলে সন্তানেরা বেপথে চলে যাবে।’
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে দুর্নীতি, অপরাধ ও অপরাধের নানা উপাদান রয়েছে, কিশোররা তার বাইরে নয়। পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়ছে। এলাকায় খেলার মাঠ নেই। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাও নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তারকাখ্যাতি, হিরোইজম, ক্ষমতা, বয়সের অপরিপক্বতা, অর্থলোভ। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। পারিবারিক শিক্ষার অভাবও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আবার মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজের সামান্য লাভের জন্য কিশোরদের অপরাধজগতে টেনে নেন। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করেন। কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে ওঠছে।’
সিলেট মেট্রোপলিট পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, যারা কিশোরদের শেল্টার দেন তারাও চিন্তা করা প্রয়োজন-এই কিশোর বেপথে চলে যাচ্ছে। ওই কিশোর যদি তার আপন ভাই হতো, তাহলে সে এমটি করতে পারতো না। বড়ভাইদের কারণেই দিন দিন ‘কিশোর গ্যাং’ ভয়ংকর হয়ে ওঠছে। তিনি বলেন, আমরা ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে নিয়মিত কাজ করছি। ইতোমধ্যে ২২০ জনের তালিকা করেছি। তাদের অভিভাবকদের ডেকে এনে সন্তানকে শাসন এবং সুন্দর পরামর্শের মাধ্যমে লেখাপড়ায় মনোযোগী করতে মুচলেকা রেখেছি। যাদের সাথে অস্ত্র যেমন, ছুরি-চাকু পেয়েছি তাদের সরাসরি আইনের আওতায় এনেছি। তিনি বলেন, সবাই সচেতনভাবে কাজ করে ‘কিশোর গ্যাং’ বিলুপ্ত করতে হবে। এতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন কিশোরদের অভিভাবকেরা।’
Leave a Reply